ঢাকা , রবিবার, ১৩ জুলাই ২০২৫ , ২৮ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ , ই-পেপার
সংবাদ শিরোনাম
বিএনপি ক্ষমতার জন্য নয়, গণতন্ত্র উদ্ধারে পাগল-গয়েশ্বর ডেঙ্গু রোগী বেড়েছে সাড়ে ৬ গুণ, মৃত্যু বেড়েছে ৪ গুণ আরও ৩ জনের করোনা শনাক্ত ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি আরও ১৩৭ ইনুর ভয়েস রেকর্ড, ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার অভিযোগ টানা বৃষ্টিতে চড়া সবজির বাজার মাধ্যমিক স্তরে ‘ঝরে পড়া’র প্রবণতা বাড়ার ইঙ্গিত এসএসসির ফল পুনর্নিরীক্ষণের আবেদন শুরু করবেন যেভাবে পরিবহন খাতে চাঁদাবাজি আগের মতোই চলছে প্রত্যাখ্যান হেফাজতের প্রতিহতের ঘোষণা অবৈধভাবে সমুদ্রপথে ইউরোপ প্রবেশে শীর্ষে বাংলাদেশ দেড় বছরে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে আরও দেড় লাখ রোহিঙ্গা-ইউএনএইচসিআর মালয়েশিয়ায় শ্রমবাজার উন্মুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা অনিশ্চত ধর্ষণ-গণপিটুনিতে হত্যা বেড়েছে জুনে, কমছে না অজ্ঞাত লাশের সংখ্যা-এমএসএফ খুনের পর লাশের ওপর লাফায় ঘাতকরা দেশজুড়ে রোমহর্ষক-বীভৎস হত্যাকাণ্ডে বাড়ছে উদ্বেগ সভ্যতার ইতিহাস আর সৌন্দর্যে মোড়া বিশ্বের সেরা ৭ দুর্গ ইউক্রেনকে অস্ত্র দেবে যুক্তরাষ্ট্র অর্থ দেবে ন্যাটো: ট্রাম্প ভুল স্বীকার করে ক্ষতিপূরণ দিলে আলোচনায় বসবে ইরান পাকিস্তানে ৯ বাসযাত্রীকে অপহরণের পর গুলি করে হত্যা
১১ বোর্ডে ৩২,৪৭৯ জন শিক্ষার্থী অনুপস্থিত

মাধ্যমিক স্তরে ‘ঝরে পড়া’র প্রবণতা বাড়ার ইঙ্গিত

  • আপলোড সময় : ১৩-০৭-২০২৫ ১২:৪১:০৩ পূর্বাহ্ন
  • আপডেট সময় : ১৩-০৭-২০২৫ ১২:৪১:০৩ পূর্বাহ্ন
মাধ্যমিক স্তরে ‘ঝরে পড়া’র প্রবণতা বাড়ার ইঙ্গিত

* ছাত্রীদের অনুপস্থিতির হার তুলনামূলকভাবে বেশি
* নেপথ্যে রয়েছে বাল্যবিয়ে,অর্থনৈতিক টানাপোড়েন ও অভিভাবকদের অসচেতনতা


চলতি বছরের এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় দেশের ১১টি শিক্ষা বোর্ডে অনুপস্থিত ছিল ৩২ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী, যারা রেজিস্ট্রেশন করেও পরীক্ষার হলে আসেনি। এই বিপুল অনুপস্থিতি নিয়ে শিক্ষাবিদদের মধ্যে তৈরি হয়েছে উদ্বেগ। তাদের মতে, এটি দেশের মাধ্যমিক শিক্ষায় ঝরে পড়ার ক্রমবর্ধমান সংকটের ইঙ্গিত দেয়। বিশেষ করে ছাত্রীদের অনুপস্থিতির হার তুলনামূলকভাবে বেশি, যা বাল্যবিয়ে, অর্থনৈতিক টানাপোড়েন, ও অভিভাবকদের অসচেতনতার মতো গভীর সামাজিক সমস্যাকে সামনে এনেছে। শিক্ষা ব্যবস্থার এই নীরব বিপর্যয় মোকাবিলায় দীর্ঘমেয়াদি উদ্যোগের তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
বোর্ড ভিত্তিক বিশ্লেষণে দেখা গেছ, সবচেয়ে বেশি অনুপস্থিত পরীক্ষার্থী ছিল ঢাকা বোর্ডে। ৯৪৬ জন ছাত্র  এবং ২ হাজার ৩০২ জন ছাত্রীসহ মোট ৩ হাজার ২৪৮ জন পরীক্ষায় অংশ নেয়নি। তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড, যেখানে ৮ হাজার ৭১২ জন পরীক্ষার্থী অনুপস্থিত ছিল, এর মধ্যে ছাত্র ৩ হাজার ৯০০ এবং ছাত্রী ৪ হাজার ৮১২ জন। এছাড়া রাজশাহী বোর্ডে অনুপস্থিত ২ হাজার ৪৮২ জন, কুমিল্লা বোর্ডে ২ হাজার ২৫১ জন, যশোর বোর্ডে ২ হাজার ৬৩৯ জন এবং দিনাজপুর বোর্ডে অনুপস্থিত ছিল ২ হাজার ৮৩৩ জন শিক্ষার্থী। বরিশাল বোর্ডে অনুপস্থিত ছিল ১ হাজার ৭৭১ জন, ময়মনসিংহে ১ হাজার ৬০৩ জন, সিলেট বোর্ডে ৭৯৪ জন এবং চট্টগ্রামে অনুপস্থিত পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ৬৪৫ জন। কারিগরি শিক্ষা বোর্ডেও অনুপস্থিত ছিল ৫ হাজার ৫১৫ জন পরীক্ষার্থী- এর মধ্যে ছাত্র ৩ হাজার ৭৯৩ এবং ছাত্রী ১ হাজার ৭২২ জন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে ঢাকা শিক্ষা বোর্ড অনুপস্থিতির কারণ অনুসন্ধানে এক জরিপ পরিচালনা করছে। এতে অংশ নেওয়া ১ হাজার ৩৫০ জন অনুপস্থিত শিক্ষার্থীর মধ্যে ৪২ শতাংশ পরীক্ষায় অংশ নেয়নি বিয়ের কারণে। তাদের ৯৭ শতাংশই ছাত্রী, তাদের বেশিরভাগ গ্রামাঞ্চলের বাসিন্দা। পরিসংখ্যান বলছে, মোট অনুপস্থিতদের মধ্যে ১৩ হাজার ৭৯০ জন ছেলে এবং ১৮ হাজার ৭০৩ জন মেয়ে। অর্থাৎ ছাত্রীদের মধ্যে অনুপস্থিতির হার তুলনামূলক বেশি।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে ঢাকা শিক্ষা বোর্ড অনুপস্থিতির কারণ অনুসন্ধানে এক জরিপ পরিচালনা করছে। এতে অংশ নেওয়া ১ হাজার ৩৫০ জন অনুপস্থিত শিক্ষার্থীর মধ্যে ৪২ শতাংশ পরীক্ষায় অংশ নেয়নি বিয়ের কারণে। তাদের ৯৭ শতাংশই ছাত্রী, তাদের বেশিরভাগ গ্রামাঞ্চলের বাসিন্দা। জরিপে আরও দেখা যায়, অনুপস্থিতদের মধ্যে ২৫ শতাংশ অসুস্থতা, ১২ শতাংশ প্রস্তুতির অভাব, ৬ দশমিক ৭ শতাংশ কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ, ৩ দশমিক ৬ শতাংশ বিদেশে চলে যাওয়া, ১ দশমিক ৬ শতাংশ গর্ভধারণ এবং ১ দশমিক ৪ শতাংশ মৃত্যুজনিত কারণে পরীক্ষা দিতে পারেনি। অনুপস্থিতদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ছিল মানবিক বিভাগ থেকে- ৬৮ শতাংশ, যার মধ্যে বড় একটি অংশ মেয়ে এবং গ্রামাঞ্চলের।
বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক প্রফেসর ড. মোহাম্মদ কামরুল আহসান বলেন, চলতি বছরের দাখিল পরীক্ষায় অনেক কেন্দ্রে শিক্ষার্থীদের অনুপস্থিতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। এটি কেবল সংখ্যার হিসাব নয় এর পেছনে সামাজিক, অর্থনৈতিক কিংবা পারিবারিক বিভিন্ন বাস্তবতা থাকতে পারে। সেসব বিষয় আমরা গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করছি। তিনি বলেন, অনুপস্থিতির এ প্রবণতা একটি গবেষণার বিষয়। আমরা এখনই কোনো দ্রুত সিদ্ধান্তে যেতে চাই না। এজন্য আমরা একটি বিস্তারিত জরিপ কার্যক্রম হাতে নিয়েছি। মাঠ পর্যায়ে তথ্য সংগ্রহ করা হবে এবং বিভিন্ন কেন্দ্র ও প্রতিষ্ঠানের প্রধানদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে। শিক্ষার্থীরা কেন পরীক্ষায় অংশ নেয়নি, তারা কি স্বাস্থ্যগত কারণে, পারিবারিক সমস্যায়, অথবা প্রাতিষ্ঠানিক অসঙ্গতির কারণে অনুপস্থিত- এ বিষয়গুলো আমরা স্পষ্টভাবে জানতে চাই। কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক প্রফেসর রুনা নাছরীন বলেন, চলতি বছরের পরীক্ষায় কিছু শিক্ষার্থীর অনুপস্থিতি আমাদের নজরে এসেছে। বিষয়টি আমরা অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেখছি। এখনই কোনো চূড়ান্ত মন্তব্য করা ঠিক হবে না, কারণ এর পেছনে নানামুখী কারণ থাকতে পারে। আমরা বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিতভাবে কাজ করছি। তিনি বলেন, বর্তমানে মাঠপর্যায়ে তথ্য সংগ্রহ চলছে। কেন্দ্র ও প্রতিষ্ঠান ভিত্তিক উপস্থিতির হার যাচাই করা হচ্ছে। সব তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণের পরই আমরা নিশ্চিত করে বলতে পারব, অনুপস্থিতির প্রকৃত কারণ কী। বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
শিক্ষাবিদদের মতে, শিক্ষাবিদ ও বিশ্লেষকদের ভাষ্য অনুযায়ী, এই অনুপস্থিতি কেবল একটি পরীক্ষার অংশগ্রহণ না করার সংখ্যা নয়- বরং এটি একটি শিক্ষাব্যবস্থার নীরব সংকট। তারা বলছেন, যারা এসএসসির রেজিস্ট্রেশন করেও পরীক্ষায় অংশ নেয়নি, তাদের বড় একটি অংশ হয়তো আগেই পড়ালেখা থেকে ঝরে পড়েছে। কেউ হয়তো দরিদ্রতার চাপে কাজে নেমে গেছে, কেউ পড়েছে পারিবারিক দ্বন্দ্বে, কেউবা স্কুলে ফিরে আসার পথ খুঁজেই পায়নি।
ঢাকা কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ অধ্যাপক আই কে সেলিম উল্লাহ খোন্দকার বলেন, শিক্ষা শুধু পাঠ্যক্রম নয়, এটি একটা জীবন্ত কাঠামো। কাঠামো বলতেই সেখানে ফাঁটল আসবে, কখনো ভিত্তিতে, কখনো ছাদে কিন্তু আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে সেই ফাঁটল চিনে ফেলা এবং সময়মতো তা মেরামত করা। সম্প্রতি এসএসসিতে বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীর অনুপস্থিতি আমাদের চোখে সেই ফাঁটলটিই বড় করে দেখিয়েছে। তিনি মনে করেন, এই অনুপস্থিতির হার শুধু সংখ্যা নয় বরং শিক্ষার মানবিক অংশে ফিরে তাকানোর ডাকও। আমরা কীভাবে শিক্ষা ব্যবস্থাকে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক, সহনশীল ও প্রাসঙ্গিক করে তুলতে পারি সেটি বিবেচনায় নিতে হবে।
বাংলা একাডেমির সদস্য ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক অনিন্দ্য ইকবাল বলেন, পরীক্ষায় এত অনুপস্থিত থাকা মানে শুধু ফাঁকা সিট নয়, বরং প্রতিটি অনুপস্থিতির পেছনে একটি জীবন, একটি সম্ভাবনা হারিয়ে যাচ্ছে। যদি তাদের শিক্ষার পথ আবার চালু না করা যায়, তাহলে ভবিষ্যতে বড় সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যর্থতার মুখে পড়তে হবে। তিনি বলেন, এমন অবস্থায় কার দায়, কী সমাধান-এ প্রশ্ন এখন অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। পরিবারের ভূমিকাকে যেমন গুরুত্ব দিতে হবে, তেমনি বিদ্যালয় ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ঝরে পড়া রোধে আলাদা প্রকল্প, কাউন্সেলিং, অনুদান ও পুনঃভর্তির ব্যবস্থা থাকা দরকার। ঝরে পড়ার পূর্বাভাস শনাক্ত করে আগে থেকেই প্রতিরোধ ব্যবস্থা নেওয়া দরকার বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
 

নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata

কমেন্ট বক্স